মুরীদের উপর পীর সাহেবের খাস দৃষ্টিকেই “তাওয়াজ্জুহ” বলে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টির সাথে প্রকৃত পীর অলীদের ঐ দৃষ্টির কোন মিল নেই, অনেক ব্যবধান। প্রকৃত পীর অলীদের তাওয়াজ্জুহ বা দৃষ্টি হল তাদের আত্মিক শক্তি। এআত্মিক শক্তির মাধ্যমে আরা মুহূর্তের ব্যবধানে যে কাউকেই অলী বানিয়ে ফেলতে পারেন। হযরত মাওলানা আব্দুলআজীজ মোহাদ্দেছে দেহলভি (রঃ) তাঁর অন্যতম গ্রন্থ “তাফসীরে ফতহুল আজীজে” বলেন, কামেল ব্যক্তির আত্মার শক্তি যা পরের আত্মার উপর তা’ছির বা প্রভাব বিস্তার করে তা চার ভাগে বিভক্ত। যথাঃ-
ক) এনয়েকাসী ঃ এটা সাধারণ পর্যায়ের তাওয়াজ্জুহ। এটা মুরীদের ক্বলবে সরবরাহ করার পর, যতক্ষণ মুরীদ পীরের নিকট থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রভাব বজায় থাকে। পীরের সান্নিধ্য ছেড়ে গেলে সেই তাছির বা প্রভাব বিলীন হয়ে যায়। যেমন- কোন ব্যক্তি শরীরে সুগন্ধি মেখেকোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে, যতক্ষণ সেখানে লোকটি উপস্থিত থাকবে, ততক্ষণ সুগন্ধি অনুভব হবে। চলে গেলে আর সুগন্ধি থাকবে না।
খ) এলক্বায়ী ঃ এলক্বা অরবী শব্দ। এর অর্থ কোন কিছু ঢেলে দেওয়া। কামেল পীর স্বীয় আত্মিক শক্তির কিছুটা মুরীদের আত্মায় ঢেলে দেন। সেজন্য এর নামকরণ এরূপ। উদাহরণ স্বরূপ কোন ব্যক্তি খোলা প্রদীপে ফিতাও তেল দিল। কিন্তু নিজের কাছে আগুন নেই বরেম প্রদীপ জ্বালাতে পারলনা। এমতাবস্থায় অন্য কোন লোকের নিকট থেকে আগুন নিয়ে বাতি জ্বালালো। তখন বাতিটি জ্বলতে ও আলো ছড়াতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ ঝড় তুফান আরম্ভ হওয়ায় বাতি নিভে অন্ধকার হয়ে গেল। তদ্রুপ পীরের এ ধরনের তাওয়াজ্জুর ফলে মুরীদের আত্মায় ঈমানের আলো জ্বলে উঠে কিন্তু সামান্য ঝড়ের সম্মুখীন হলেই নিভে যায়। অর্থাৎ নফসানী খাহেশ ও শয়তানী ওয়াছওয়াছার মোকাবেলায় দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকতে পারেনা। এটা আবার এনয়েকাসী তাওয়াজ্জুহ অপেক্ষা শক্তিশালী।
গ) ইছ্লাহী ঃ সংশোধনমূলক। যদি কেউখুব বড়, ভরা কলসীর পানি উপর থেকে ময়লা আবর্জনাপূর্ণ একটি পেয়ালায় ঢালতে শুরু করে, তাহলে যেমন পানির ধাক্কায় পেয়ালার সব ময়লা আবর্জনা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। তাহলে যেমন পানির ধাক্কায় পেয়ালার সব ময়লা আর্বজনা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। তেমনি কামেল পীরের এই ইছলাহী তাওয়াজ্জুরফলে মুরীদের আত্মায় যাবতীয় কলুষ ও কালিমা দূর হয়ে যায়। আর তখন মুরীদের ক্বলব বা দিল আল্লাহ এবং রাসুলের মহব্বত ধারণ করায় উপযোগী হয়ে উঠে। এজন্য অনেক জঘন্য পাপীকে কামেল পীরের হাতে বায়াত হওয়ার পর সমস্ত পাপাচার হতে বিরত থেকে ইশকে ইলাহীর পথে অগ্রসর হতে দেখা যায়। এটা এনয়েকাসী ও এল ক্বায়ী তাওয়াজ্জুহ অপেক্ষা অধিক শক্তি শালী।
ঘ) এত্তেহাদী ঃ এত্তহাদ শব্দের অর্থ ঐক্য। এটা এমন প্রকার তাওয়াজ্জুহ্ যার প্রভাবে কামেল পীরের আত্মার সংগে মুরীদের আত্মা একাকার হয়ে যায়। এ ধরণের তাওয়াজ্জুর বরকতে জঘন্য পাপী ও মুহূর্তের মধ্যে আল্লাহর অলী হয়ে যেতে পারে। এটা সবচেয়ে শক্তিশালী তাওয়াজ্জুহ। এরকম তাওয়াজ্জুর অধিকারী কামেল পীরের সংখ্যা যেমন খুবই কম, তেমনি এটা সহ্য করার মত মুরীদের সংখ্যাও বিরল। অযোগ্য এবং অনুপযুক্ত মুরীদের ক্বলবে এ তাওয়াজ্জুর ধাক্কা পড়লে, তাঁর প্রতিক্রিয়ায় মুরীদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ কারণে কামেল পীরেরা সাধারণত, হঠাৎ এ রকম তাওয়াজ্জুহ দেন না। প্রতমে কম শক্তি সম্পন্ন তাওয়াজ্জুহ্ প্রদানের মাধ্যমে মুরীদদেরকে উপযুক্ত করে তোলেন, তারপরই নিজের আত্মিক শক্তি পুরোপুরি প্রয়োগ করেন।
অনেক হক সিলসিলায় দেখা যায়, পীরের চেয়ে মুরীদের কর্তব্য দায়িত্ব বেশী। কিন্তু মুনিরীয়া সিলসিলায় পীরের কর্তব্য ও কষ্ট বেশী। পীর সাহেবকে মুরীদের রোগ সম্পর্কে অবগত হতে হয়। তারপরই তাওয়াজ্জুহ দ্বারা মুরীদের আত্মার উপর স্বীয় আত্মিক শক্তি প্রয়োগ করে, আস্তে আস্তে হিংসা, দ্বেষ, লোভ লালসা,কাম, ক্রোধ, রিয়া ইত্যাদি থেকে মুক্ত করে আল্লাহ এবং রাসুলের মহব্বতের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। কোন পীর যদি মুরীদের রোগ নির্ণয়ের অক্ষম হয়, তাহলে হাঁতুড়ে ডাক্তারের হাতে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার মত হাস্যকর ঘটনার সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ পীরের জন্য মুরীদের ইহকাল এবং পরকাল দুটিই সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এ সিলসিলার নিয়মানুযায়ী মুরীদ ৩/৪ মাস সিলসিলার নির্দিষ্ট “অজিফাহ” পড়ার পর, নতুন ছবকের জন্য অর্থাৎ (ক্বলবের ছবকের জন্য) পীর সাহেবের শরণাপন্ন হবে। পীর সাহেব মাগরিবের নামাজান্তে ২ রাকাত “ছালাতুত্তাওবার” নামায পড়তে বলবেন এবং তারপর মুরীদকে পীর সাহেব মুখোমুখি চোখ বন্ধ অবস্থায় যেখানে ক্বলবের অবস্থান সেখানে গভীরভাবে খেয়াল করতে বলবেন। তারপর পীর সাহেব,কোরআনের আয়াত পড়ে পড়ে তাওয়াজ্জুহ্ প্রদান করবেন। এমন সময় মুরীদ তাঁর ক্বলবে গরম, ঠান্ডা বা নড়াচড়া অনুভব করতে পারবে। যদি কোন মুরীদ ঐ সময় অনুভব অনুভূতি আন্দাজ করতে না পারে, তাহলে অসুবিধে নেই সিলসিলার নিয়মানুযায়ী মোরাকাবা করতে থাকলে ইন্শাআল্লাহ ১০/১৫ দিনের মধ্যেই তা বুঝতে সক্ষম হবে। মুনিরীয়া সিলসিলা এমন একটি সিলসিলা সম্পূর্ণ বাস্তবধর্মী। আপনার কলজেতে “ঘা” হয়েছে, এখন আপনি যদি ডাক্তারের ওষুধ পেটের উপর মালিশ করেন তাহলে কি রোগ সেরে যাবে? এ সিলসিলা ও এমন মনগড়া সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করে না। কারণ যেখানে “ঘা” সেখানেই ওষুধ। এটাই হল নিয়ম। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ফরমান,মানুষের ক্বলব বা দিলে শয়তান কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। তাই এ সিলসিলার নিয়মানুযায়ী পীর মাশায়েখরা শয়তানকে ক্বলব থেকে তাড়িয়ে, সেখানে আল্লাহর যিকির প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদের তাওয়াজ্জুহ বা আত্মিক শক্তির মাধ্যমে পবিত্র নূরকে মুরীদের ক্বলবে ঢুকিয়ে দেন এবং ঐ নূরের তা’ছির বা প্রবাব মুরীদ সহজেই অনুভব করতে পারে হযরত নবী করিম (সঃ) ফরমান, “মোমেন বান্দার ক্বলব, আল্লাহর আরশ”। আমরা সকলেই তো নিজকে আল্লাওয়ালা মনে করি, কিন্তু কখনো কী নিজের ক্বলবে আমরা আল্লাহর অধিষ্ঠান উপলব্দি করেছি? কিন্তু আল্লাহ পাক ফরমান, তোমাদের নিজদের ভেতর আমার পাক সত্বার নির্দশন রয়েছে, তোমরা কেন তা দেখতে পাওনা। আয়নার চেহারা দেখা যায, কিন্তু তাঁর উপর কাদা মেখে দিলে কিছুই দেখা যায় না। তেমনি ক্বলব বা দিলের সম্মুখভাবে গুনাহের একটি কালো পর্দা বা আবরণ থাকে। মূলত পাপ করতে করতে এ পর্দার সৃষ্টি হয়। কাপড় পরিষ্কার করতে সাবান বা সোডার প্রয়োজন হয়, লোহার তৈরি জিনিসে মরিচা ধরলে কামারের কাছে নিতে হয়। কাঁচ বা কাঠে ময়লা জমলে স্পিরিট দিয়ে ঘষ্তে হয়। কিন্তু ক্বলব পরিষ্কারের ঐ “স্পিরিট” প্রকৃত পীর অলীদের ক্বলবে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন বাজারে পাওয়া যাবে না। একমাত্র কামেল পীর-অলীরা যখন তাদের পাক তাওয়াজ্জুর মাধ্যমে হযরত নবী করিম (সঃ) এর সিনা মোবারকের যে পবিত্র নূর শেরে খোদা হযরত আলী (রঃ) হয়ে ক্রমান্বয়ে পীর অলীদের ক্বলবে সংরক্ষিত রয়েছে, ঐ নূর মোবারক যখন তারা মুরীদের ক্বলবে ঢেলে দেবেন, তখন ক্বলবের সামনে গুনাহের ঐ কালো পর্দা সরে যাবে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন ক্বলবে ঐ পবিত্র নূর স্থান নেবে। তকন থেকে মুরীদ ক্বলবে আল্লাহর অধিষ্ঠান উপলদ্ধি করার পথে এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ ঘড়ির কাটার মত টিক্ টিক্ যিকিরের শব্দ মুরীদ ক্বলবে অনুভব করতে পারবে। সেজন্য আল্লাহ পাক ফরমান, তোমাদের নিজেদের ভেতর আমার অধিষ্ঠান কেন তোমরা দেখতে পাওনা। আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেন,এখন আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করব, পৃথিবীর দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে, ফলে তাদের কাছে ফুটে উঠবে যে, এ কোরআন সত্য।
হযরত নবী করিম (সঃ) ফরমান,“সাবধান”! শরীরের মধ্যে এক টুকরো গোশত পিন্ড রয়েছে, যদি সেটা সংশোধিত হয়, তবে সমস্ত শরীরই সংশোধিত হয়, আর যদি খারাপ হয়, তাহলে সমস্ত শরীরই খারাপ হয়। মনে রেখ ঐ গোশত পিন্ডটি হল ক্বলব।”
এই ক্বলব বা আত্মাকে পবিত্র করার নিয়মাবলী যে ইলম দ্বারা জানা যায়, তাকে “ইলমে তাসাউফ” বলে। তাসাউফ, শব্দের ব্যবহারিক অর্থ মানব অন্তকরণ- কাম, ক্রোধ, হিংসা লোভ ইত্যাদি কলুষিত থেকে পবিত্র বা পরিষ্কার হওয়া। আমাদের দেশে ইলমে তাসাউফকে মারেফাতও বলে এবং ত্বরিকতও বলে। সুতরাং উপরোক্ত তথ্যনির্ভরশীল আলোচনা থেকে এটাই বোঝা যায়, নামায পড়তে পড়তে কপালে দাগ তুলে ফেললেও যতক্ষণ পর্যন্ত ক্বলবে আল্লাহর অধিষ্ঠান আন্দাজ করা যাবে না, অর্থাৎ ক্বলব থেকে শয়তান বিতাড়িত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যক্তি প্রকৃত মোমেন হবে না। তাই আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ফরমান,এমন একদিন আসবে যে দিন ধন-সম্পদ-সন্তান-সন্ততি কোন লাভ দেবে না, শুধুমাত্র যে ব্যক্তি খোদার সামনে পরিষ্কার ক্বলব নিয়ে আসবে।