ইসলামী-শরীয়ত-অনুযায়ী-ত্বরীক্বত-তরিকত-গ্রহন-করা-তথা-কামিল-মোর্শেদের-দীক্ষা-গ্রহনের-প্রয়োজনীয়তা

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

(আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি অত্যন্ত দয়ালু ও পরম করুণাময়।)

ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী ত্বরীক্বত তথা তরিকত গ্রহন করার, কামিল মোর্শেদের তথা মুর্শিদের দীক্ষা গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা

প্রথমেই জানা আবশ্যক যে, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী ত্বরীক্বত তথা তরিকত গ্রহন তথা ইলমে তাসাওউফ শিক্ষা করার বিষয়ে শরয়ী দিক নির্দেশনা --

ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ অর্জনের লক্ষ্যে ত্বরীক্বত তথা তরিকত গ্রহনের প্রয়োজনীয়তার ব্যপারে ফোকাহায়ে কিরামগন সুবিস্তৃত মত প্রকাশ করে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে সু-প্রসিদ্ধ ফিকাহর কিতাব ফতোয়ায়ে শামী এর মধ্যে বর্ণিত আছে --

(علم القلب) اى علم الاخلاق و هو علم يعرف به انواع الفضائل و كيفية اكتسابها و انواع الرذائل و كيفية اجتنبها- (رد المختار- جلد اول)

অর্থ্যাৎ যে ইলমের মাধ্যমে মানুষের সদগুনাবলীর প্রকারভেদ এবং তা অর্জনের পন্হা, এবং অসৎগুনাবলীর শ্রেনী বিভাগ এবং তা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় অবগত হওয়া যায়, তাকে ইলমে ক্বালব বা ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ বলে।

দুররুল মুখতার কিতাবে আছে--

" اعلم ان تعلم العلم يكون فرض عين و هو بقدر ما يحتاج دينه و فرض كفاية و هو ما زاد عليه لنفع غيره و مندوبا و هو التبحر فى الفقه و علم القلب--"

অর্থ্যাৎ ইলম আবশ্যক পরিমাণ শিক্ষা করা ফরযে আইন। অপরকে শিক্ষা দেওয়ার মানসে স্বীয় আবশ্যকের অতিরিক্ত শিক্ষা করা ফরযে কেফায়া এবং বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করার মানসে শিক্ষা করা মুস্তাহাব। এরূপ ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ অবস্থাভেদে শিক্ষা করা ফরযে আইন, ফরযে কেফায়াহ ও মুস্তাহাব।

দুররুল মুখতার কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থ গায়াতুল আওতার কিতাবে আছে-

" تو علم قلب فقہ پر عطف ھے نہ تبحر پر تو مطلب یہ ھوا کہ اصل علم اخلاق فرض ھے اور اسمین تبحر کرنا ۔ستحب ھے --"

অর্থ্যাৎ উপরোক্ত আরবী ইবারতে علم القلب বাক্যাংশটি مندوب এর সাথে সংযোজিত নয় বরং উক্ত ইবারতের মধ্যস্হিত علم التصوف শব্দের সাথে সংযোজিত। অতএব দ্বারা এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করা প্রকৃতপক্ষে ফরয এবং তাতে পারদর্শিতা লাভ করা মুস্তাহাব।

এ প্রসঙ্গে আল্লামা কারামত আলী জৈনপুরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তদীয় জাদুত্তাকওয়া নামক কিতাবে "হাদীসে জিবরাঈল" এর মর্মে আলোকপাত করেছেন--

" کہ دین بولتے ہیں اسلام-ایمان و احسان سب کو ملاکے اور شريعت نام اس مجموعہ کا بے اور بھے فرمایا ھے کہ فقہ اور تصوف اور کلام آپس میں ایک کو ایک لازم ھے ایک سے دوسرا الگ نہیں ان میں سے ایک بے دوسرا کے پورا نہیں ھوتا ھے-"

অর্থাৎ- ইসলাম, ঈমান ও ইহসান এই তিনটি মিলে দ্বীন বা শরীয়ত। তিনি আরও লিখেছেন যে- তাসাওউফ তথা তাসাউফ, ফিকহ ও আকাঈদ প্রভৃতির সমাধার জন্য এবং ইহা যথার্থরুপে প্রতিপালনের জন্য একটি অন্যটির দিকে বিশেষ ভাবে মুখাপেক্ষী। তারা একটি হতে অপরটি ভিন্ন নয় এবং একটি ছাড়া অপরটি পূর্ণ হতে পারে না।

তিনি উক্ত জাদুত্তাকওয়া কিতাবে আরও লিখেছেন--

" اور یہ بھی معلوم ھو چکا کہ فقہ کے موافق عمل بھی بے تصوف کے درست نہیں ھوتا تو اب ثابت هوا کہ مؤمن کو تصوف پر عمل کرنیکی بڑی حاجت ھے اور تصوف پر عمل کرنا بغير صحبت اور تعليم مرشد کامل کے جو تصوف سے واقف اور اسپر عامل ھے ممکن نہیں--"

অর্থ্যাৎ ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ ব্যতীত ফিকহের উপর যথার্থরূপে আমল করা যায় না। সুতরাং এতদ্বারা এটাও সুপ্রমানিত হল যে, ইলমে তাছাওউফ অনুশীলন করা প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির উপর অবশ্য কর্তব্য। তা করা তাসাওউফবিদ ও তার অনুধাবনকারী উপযুক্ত পীরের ছোহবত ও তা'লীম ব্যতীত সম্ভবপর নয়।

সুতরাং আলোচনা-পর্যালোচনার আলোকে এটাই প্রমাণীত হয় যে--

সম্মানিত ইসলামী শরীয়তের ফতওয়া হলো--

কামিল শায়খ বা মোর্শেদ ক্বিবলার কাছে বাইয়াত হওয়া ফরয। এটাই হচ্ছে দলীলসম্মত এবং হাক্বীক্বী ফতওয়া।

☆ কেননা ইখলাছ তথা একনিষ্ঠতা অর্জন করা হচ্ছে ফরয। আর ইখলাছ হাছিল হয়ে থাকে কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার ছোহবত মুবারকের নূর এবং উনার দেয়া সবক্ব, তাওয়াজ্জুহ,ক্বালবী যিকির ও মোরাক্বাবা-মোশাহেদা করার দ্বারা। আর এসকল প্রতিটি বিষয়ই ফরযের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হওয়া তথা উনার সান্নিধ্য গ্রহণ করা ফরয।

☆ কামিল মোর্শেদের ছোহবত ইখতিয়ার করা উনার থেকে ফয়েয-তাওয়াজ্জুহ হাছিল করা ফরয। কেননা ক্বলবী যিকির-আযকার জারি করা অত্যন্ত জরুরী ও কর্তব্য। কারন ক্বালবী যিকির ব্যতীত আত্মিক পরিশুদ্ধি কখনও সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে তাওয়াজ্জুহ বিশিষ্ট ত্বরীক্বতের মোর্শেদে কারীমের খাস নেগাহে করম তথা তাওয়াজ্জুহ নিক্ষেপ ব্যতীত ক্বলবী যিকির জারি তথা দায়েমী যিকির করার অসম্ভব। স্মরণীয় যে, মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিলের উদ্দেশ্যে ইবাদত বা আমল করার নাম ইখলাছ তথা একনিষ্ঠতা। অর্থাৎ প্রত্যেক পুরুষ ও মহিলাকে ইখলাছ অর্জন করতে হবে। অন্যথায় আমল করে ফায়দা বা মর্যাদা হাছিল করা তো দূরের কথা নাজাত লাভ করাটাই কঠিন হবে।

কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

" الناس كلهم هلكى الا الـمؤمنون والـمؤمنون كلهم هلكى الا العالـمون والعالـمون كلهم هلكى الا العاملون والعاملون كلهم هلكى الا الـمخلصون"

অর্থ : সমস্ত মানুষ ধ্বংস মু’মিনগণ ব্যতীত এবং মু’মিনগণও ধ্বংস আলিমগণ ব্যতীত এবং আলিমগণও ধ্বংস আমলকারীগণ ব্যতীত এবং আমলকারীগণও ধ্বংস ইখলাছ অর্জনকারীগণ ব্যতীত। (মিরকাত শরীফ)

যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

" وما امروا الا ليعبدوا الله مخلصين له الدين"

অর্থ: ঈমানদারদেরকে আদেশ করা হয়েছে তারা যেনো খালিছভাবে একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যে ইবাদত বন্দিগী করে। (সূরা বাইয়্যিনাহ শরীফ: আয়াত শরীফ- ৫)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

" عن حضرت ابى امامة الباهلى رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله لا يقبل من العمل الا ما كان له خالصا وابتغى به وجهه"

অর্থ: “হযরত আবূ উমামা আল বাহিলী (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) তিনি বর্ণনা করেন-নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক ওই আমল কবুল করবেন না, যা ইখলাছের সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক অর্জনের জন্য করা না হয়।” (নাসায়ী শরীফ, দায়লামী শরীফ)

উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে কোন আমল করা হলে তা হবে গইরুল্লাহর। তা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কখনোই কবুলযোগ্য হবে না। তা যত বড় আমলই হোক না কেন।

যার উদাহরণ মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সূরা মাঊন উনার মধ্যে উল্লেখ করেছেন।

" فويل للمصلين"

অর্থাৎ, নামায আদায়কারীদের জন্য আফসুস তথা জাহান্নাম। (যারা পরিপূর্ণভাবে একনিষ্ঠতার সহিত একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করতে ব্যর্থ) (পবিত্র সূরা মাঊন শরীফ: আয়াত শরীফ -৪)

অনুরূপভাবে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি পবিত্র হাদীছ শরীফের মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

যা মুসলিম শরীফর মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

"মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিলের উদ্দেশ্য না থাকার কারণে জিহাদকারী জিহাদ করা সত্বেও, ক্বারী কুরআন শরীফ শিক্ষা দেয়া সত্বেও এবং আলিম ইলম উনার প্রচার প্রসার করা সত্বেও এবং দানশীল দানের সমস্ত রাস্তায় দান করা সত্বেও তাদের সকলকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।" নাউযুবিল্লাহ!

কাজেই আমল করতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিলের উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ ইখলাছের সাথে আমল করতে হবে। তবেই সে আমলের দ্বারা-পরিপূর্ণ ফায়দা বা মর্যাদা লাভ করা সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

" اخلص دينك يكفيك العمل القليل"

অর্থ: ইখলাছের (একনিষ্ঠতার সাথে) সাথে আমল করো। অল্প আমলই তোমার নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে। -(আল মুসতাদরাক লিল হাকিম)

অতএব, প্রত্যেকের জন্য ইখলাছ অর্জন করা ফরয। আর ইলমুল ইখলাছ উনার অপর নামই হচ্ছে ইলমুল ক্বলব বা ইলমুত তাছাওউফ।

 

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

" عن حضرت الحسن رحمة الله عليه قال العلم علمان فعلم فى القلب فذاك العلم النافع وعلم على اللسان فذالك حجة الله عز وجل على ابن ادم"

অর্থ: “হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, ইলম দু’প্রকার-একটি হচ্ছে ক্বলবী ইলম (ইলমে তাছাওউফ) যা উপকারী ইলম। অপরটি হচ্ছে যবানী ইলম (ইলমে ফিক্বাহ) যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।” (দারিমী, মিশকাত, মিরকাত, মাছাবীহুস সুন্নাহ)

অলী কুল সম্রাট হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম শাহেন শাহে বোগদাদ আব্দুল ক্বাদির জীলানী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর সিররুল আসরার কিতাবের ভূমিকায় উল্লেখ আছে যে--

" فالعلم المنزل علينا علمان ظاهر و باطن يعنى الشريعة والمعرفة فامر بالشريعة على ظاهرنا بالمعرفة على باطننا لينتج من اجتماعهما علم الحقيقة كاالشجرة و الاوراق يحصل منهما الثمر "

অর্থ্যাৎ আমাদের প্রতি আল্লাহ তা'য়ালা কতৃক যা অবতীর্ণ হয়েছে তা দু' ভাগে বিভক্ত : প্রথমত: ইলমে জাহের দ্বিতীয়ত: ইলমে বাতেন। অর্থ্যাৎ ইলমে শরীয়ত ও ইলমে মা'রেফত।

শরীয়তের সাহায্যে আমরা বাহ্যিক কাজ-কর্ম করার আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি এবং ইলমে মা'রেফাতের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ বা মানসিক কাজ-কর্ম করার আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি। এতদুভয় প্রকারের ইলমের সাহায্যে আমরা হাক্বীক্বত বা খোদাপ্রাপ্তির পথ উপনীত হতে পারি। যেমন: বৃক্ষ ও পত্রপুষ্প সমন্বয়ে ফল লাভ হয়ে থাকে।

অনুরূপ সিররুলআসরার কিতাবের ৫ম অধ্যায়ে তাওবার বয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

" و لذالك طلب اهل التلقين لـحياة القلوب فرض كما قال عليه الصلاة والسلام طلب العلم فريضة على كل مسلم و مسلمة والمراد منه علم المعرفة و القربة و البواقي من العلوم الظاهر لا يحتاج اليها الا ما يؤدى لفرائض كعلم الفقه فى العبادت "

অর্থ্যাৎ অন্তরকে জীবিত করার জন্য যাবতীয় কু-রিপু হতে মনকে পবিত্র করার জন্য মা'রেফাতের পীর বা মোর্শেদ অন্বেষন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয। তালাবুল ইলমে ফারিজাতুন এর উদ্দেশ্য ইলমে মা'রেফত এবং খোদার নৈকট্য লাভ করার জ্ঞান। এছাড়া অন্যান্য শরীয়ত বিষয়ক ইলম যার যতটুকু আবশ্যক ততটুকু শিক্ষা করা ফরয। যেমন: ইবাদতের জন্য ফিকহ শিক্ষা করা ফরয।

ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তিনি বলেন, “ইলম শিক্ষা করা ফরয বলতে বুঝায় ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাছাওউফ। অর্থাৎ উভয়টিই শিক্ষা করা ফরয।

উল্লেখ্য, হযরত ইমাম আ’যম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তিনি প্রথমে আওলাদে রসূল হযরত ইমাম বাকির (রাদ্বিয়াল্লাহুআনহু) উনার কাছে মুরীদ হন এবং উনার পবিত্র বিছাল শরীফের পর উনারই ছেলে আওলাদে রসূল হযরত ইমাম জা’ফর ছাদিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহুআনহু) উনার কাছে বাইয়াত হয়ে কামালিয়াত অর্জন করেন। সুবহানাল্লাহ! (গায়াতুল আওতার ফী শরহে দুররিল মুখতার, সাইফুল মুকাল্লিদীন, ইছনা আশারিয়া ইত্যাদি)।

হযরত মোল্লা আলী ক্বারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তিনি উনার বিশ্বখ্যাত কিতাব মিশকাত শরীফের শরাহ মিরকাত শরীফ-এ "হযরত ইমাম মালিক" (রহমতুল্লাহি আলাইহি) যিনি মালিকী মাযহাবের ইমাম উনার ক্বওল উল্লেখ করেছেন যে-

" من تفقه ولـم يتصوف فقد تفسق ومن تصوف ولـم يتفقه فقد تزندق ومن جمع بينهما فقد تحقق"

অর্থ: “যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো অথচ ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো কিন্তু ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো না অর্থাৎ গুরুত্ব দিলনা, সে যিন্দিক (কাফির)। আর যে ব্যক্তি উভয়টিই অর্জন করলো, সে ব্যক্তিই মুহাক্কিক।”

জানা আবশ্যক যে, ইলমে ফিক্বাহ অর্থাৎ ওযূ, গোসল, ইস্তিঞ্জা, নামায-কালাম, মুয়ামালাত, মুয়াশারাত ইত্যাদি শিক্ষার জন্য ওস্তাদ গ্রহণ করা যেমন ফরয; সেটা মাদরাসায় গিয়েই হোক অথবা ব্যক্তিগতভাবে কোনো ওস্তাদের নিকট থেকেই হোক তা শিক্ষা করা ফরয। তদ্রূপ ইলমে তাসাওউফ শিক্ষার জন্যও ওস্তাদ গ্রহণ করা ফরয। আর এ ওস্তাদকেই আরবীতে ‘শায়েখ’ বা ‘মোর্শেদ’ বলা হয় আর ফারসীতে ‘পীর’ বলা হয়।

বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘তাফসীরে মাযহারী’ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে-

"كل ما يترتب عليه الاثر من الفروض الاعيان فهو فرض عين"

অর্থ : “যে কাজ বা আমল ব্যতীত ফরযসমূহ আদায় করা সম্ভব হয়না, ফরযগুলোকে আদায় করার জন্য সে কাজ বা আমল করাও ফরয।”

হানাফী মাযহাবের মশহূর ফিক্বাহর কিতাব --

‘দুররুল মুখতারে' উল্লেখ আছে যে-

"ما لايتم به الفرض فهو فرض"

অর্থ : “যে আমল ব্যতীত কোনো ফরয পূর্ণ হয়না, উক্ত ফরয পূর্ণ করার জন্য ওই আমল করাও ফরয।”

উল্লিখিত উছুলের ভিত্তিতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে- ইলমে তাসাওউফ তথা ইলমে তাসাউফ যেহেতু অর্জন করা ফরয আর তা যেহেতু কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হওয়া ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব নয়, সেহেতু একজন কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করাও ফরয।

শুধু তাই নয়, কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার ছোহবত ইখতিয়ার করা বা উনাকে অনুসরণ করার নির্দেশ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফের মধ্যেই রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি কালাম পাকের মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

"يايها الذين امنوا اتقوا الله وكونوا مع الصدقين"

অর্থ : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করো এবং ছাদিক্বীন বা সত্যবাদীগণ উনাদের সঙ্গী হও।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ-১১৯)

মোট কথা, যিনি বা যাঁরা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার মত মুবারক অনুযায়ী মত হয়েছেন এবং মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উনার পথ মুবারক অনুযায়ী পথ হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে খালিক্ব মালিক রব তায়ালা মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

"واتبع سبيل من اناب الى"

অর্থ : “যিনি আমার দিকে রুজু হয়েছেন, উনার পথকে অনুসরণ করো।” (পবিত্র সূরা লুক্বমান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫)

অন্যত্র খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ ফরমান-

"من يهد الله فهو الـمهتد ومن يضلل فلن تـجد له وليا مرشدا"

অর্থ : “খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি যাঁকে হিদায়েত দান করেন, সেই হিদায়েত পায়। আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে দৃঢ় থাকে, তার জন্য কোনো ওলীয়ে মোর্শেদ (কামিল শায়েখ) পাবেন না।” (পবিত্র সূরা কাহফ্ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৭)

অর্থাৎ যারা কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হয়না, তারা পথভ্রষ্ট। কারণ তখন তাদের পথ প্রদর্শক হয় শয়তান। নাউযুবিল্লাহ!

অনুরূপভাবে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা ইরশাদ ফরমান-

" يوم ندعوا كل أناس بامامهم "

অর্থ: যে দিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমাম (পথপ্রদর্শক) সহকারে আহবান করবো। (সূরা বনী ইসরাঈল: পবিত্র আয়াত শরীফ - ৭১)

উক্ত আয়াত শরীফের আলোকে বুঝা গেল যে, দুনিয়ায় কোন নেককার ব্যক্তিকে নিজের ইমাম তথা রাহবার বানিয়ে নেওয়া উচিত-- শরীয়তের বেলায় তাক্বলীদ (মাযহাবের ইমামের অনুসরন) করে এবং ত্বরীকতের বেলায় বায়'আত (কামিল, হক্কানী, আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন মোর্শেদের শীষ্যত্ব) গ্রহন করে। যাতে হাশর আহলে যিকির তথা নেককার ব্যক্তিদের সাথে হয়। যদি কারো নেককার ইমাম না থাকে, তবে তার ইমাম হবে শয়তান। উক্ত আয়াতে তাক্বলীদ, বায়'আত ও মোর্শেদের দীক্ষা গ্রহণ করা -- সব ক'টিরই প্রমাণ মিলে। (তাফসীরে নুরুল ইরফান)

যার কারণে সুলত্বানুল আরিফীন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), সাইয়্যিদুত ত্বায়িফা হযরত জুনায়িদ বাগদাদী (রহমতুল্লাহি আলাইহি), হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনারাসহ আরো অনেকেই বলেছেন যে-

" من ليس له شيخ فشيخه شيطان"

অর্থ : “যার কোনো শায়েখ বা মুর্শিদ নেই, তার মোর্শেদ বা পথ প্রদর্শক হলো শয়তান।” নাঊযুবিল্লাহ! (ক্বওলুল জামীল, নুরুন আলা নূর, তাসাওউফ তত্ত্ব)

আর শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলা উনার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

" عن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الشيخ فى اهله كالنبى فى امته " وفى رواية اخرى " الشيخ لقومه كالنبى فى امته"

অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি ইরশাদ মুবারক করেন- হযরত নবী-রসূল (আলাইহিমুস সালাম) উনারা উম্মতের নিকট যেরূপ সম্মানিত ও অনুসরণীয়, শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলা তিনিও উনার অধীনস্থদের নিকট তদ্রূপ সম্মানিত ও অনুসরণীয়।” (দায়লামী শরীফ, মাকতুবাত শরীফ, জামিউল জাওয়ামি’, আল মাক্বাছিদুল হাসানাহ, তানযীহুশ শরীয়াহ, আল মীযান, আল জামিউছ ছগীর,ইত্যাদি)

অর্থাৎ হযরত নবী-রসূল (আলাইহিস সালাম) উনার দ্বারা যেরূপ উম্মতের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রে ইছলাহ লাভ হয়, সেরূপ শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলা উনার দ্বারা মুরীদের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রে ইছলাহ লাভ হয়।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

" لا يؤمن احدكم حتى يكون الله ورسوله احب اليه من نفسه وماله ووالده وولده والناس اجمعين"

অর্থ: “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কামিল মু’মিন হতে পারবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের নিকট মহান আল্লাহ পাক তিনি ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি তোমাদের জান-মাল, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হবেন।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস্ সারী, শরহে নববী শরীফ, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত ত্বীবী)

এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি যখন উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা ইরশাদ ফরমান- তখন সেখানে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে আমি সবকিছু থেকে অধিক মুহব্বত করি কিন্তু আমার প্রাণের চেয়ে অধিক মুহব্বত এখনো করতে পারিনি। তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি বললেন, “হে হযরত ওমর ইবনুল খত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আপনি এখনও মু’মিনে কামিল হতে পারেননি।” একথা শুনে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বাচ্চা শিশুদের ন্যায় কাঁদতে লাগলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন, যেজন্য তিনি পিতা-মাতা, ভাই-বোন, বাড়ী-ঘর, ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ইত্যাদি সব ছেড়ে ঈমান গ্রহণ করেছেন, সে ঈমানই যদি পরিপূর্ণ না হয়, তাহলে এতকিছু ত্যাগ করার সার্থকতা কোথায়? হযরত ফারূক্বে আ’যমের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ) এই আকুতি দেখে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি উনাকে কাছে ডাকলেন এবং নিজ হাত মুবারক উনার সিনার উপর রাখলেন (তাসাওউফের ভাষায়- ফয়যে ইত্তিহাদী দিলেন)। সাথে সাথে হযরত ফারূক্বে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)

তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্, ইয়া হাবীবাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার এখন এরূপ অবস্থা হয়েছে যে, আমি একজন কেন? আমার ন্যায় শত-সহ সহস্র ফারূক্বে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আপনার জন্যে জান কুরবান করতে প্রস্তুত আছি।

একথা শুনে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ইরশাদ ফরমান- “হে হযরত ফারূক্বে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহুআনহু)! এতক্ষণে আপনি মু’মিনে কামিল হয়েছেন। সুব্হানাল্লাহ!

উল্লেখিত ঘটনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরামগন (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম) উনারা প্রত্যেকেই কামিল বা পরিপূর্ণ মু’মিন হয়েছেন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উনার মুবারক ছোহবত ও মুবারক ফয়েয-তাওয়াজ্জুহর কারণেই। অন্য কোন আমলের দ্বারা মু’মিনে কামিল হননি। যদি হতেন তবে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ফারূক্বে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উনাকে বলতেন, আপনি অমুক আমল বেশি বেশি করুন তবেই মু’মিনে কামিল হবেন। কিন্তু তিনি তা না বলে উনাকে ফয়েয-তাওয়াজ্জুহ্ মুবারক দিয়ে মু’মিনে কামিল বানিয়ে দিলেন। সুবহানাল্লাহ!

এ প্রসঙ্গে মশহূর ওয়াক্বিয়া বর্ণিত রয়েছে যে: মানতিকের ইমাম হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তিনি মাদরাসায় লেখাপড়া শেষ করেছেন। তিনি কিতাব পড়েছেন, ইলমে ফিক্বাহতে পান্ডিত্য অর্জন করেছেন তদুপরিও নিজেকে ইলমে তাছাওউফ এর ইলম অর্জন করতে আত্মীয় নিয়োগ করেছেন। কেননা প্রত্যেকের জন্য সেটাও ফরয। তিনি তো ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করেছেন মাদরাসায় গিয়ে। কিন্তু তখন পর্যন্ত উনার ইলমে তাছাওউফ অর্জন করা হয়নি। তাই তিনি ইলমে তাছাওউফ অর্জন করার জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী হযরত নজীবুদ্দীন কুবরা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার দরবার শরীফ-এ গেলেন। গিয়ে বললেন, হুযূর! আমি আপনার কাছে বাইয়াত হতে এসেছি। মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরার নাম কি? তিনি বললেন, আমার নাম ফখরুদ্দীন। মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী বললেন, কোন ফখরুদ্দীন, যিনি মানতিকের ইমাম? তিনি জবাব দিলেন, জী হুযূর! আমি সেই ফখরুদ্দীন। মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী হযরত নজীবুদ্দীন কুবরা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনাকে বাইয়াত করালেন। অত:পর সবক দিয়ে বললেন, তোমার ভিতর মানতিকের ইলম পরিপূর্ণ। কাজেই, তুমি আগামী এক বছর জাহেরী কোন পড়া-শুনা না করে নিরিবিলি অবস্থান করে ইলমে তাছাওউফ বা তরীক্বতের সবক আদায় করতে থাক। মোর্শেদ ক্বিবলা উনার নির্দেশ মুতাবিক তিনি নিরিবিলি অবস্থান করে তরীক্বতের সবক আদায় করতে লাগলেন। এরপর তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন মোর্শেদ ক্বিবলা তো পড়তে নিষেধ করেছেন। কিন্তু লিখতে তো নিষেধ করেননি। এ চিন্তা করে তিনি তরীক্বতের সবক আদায়ের ফাঁকে ফাঁকে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার তাফসীর লিখতে শুরু করলেন এবং বেশকিছু অংশ তাফসীর লিখলেন। যা তাফসীরে কবীর হিসেবে আজ সারাবিশ্বে মশহূর। বছর শেষে তিনি যখন উনার মোর্শেদ ক্বিবলা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার দরবার শরীফ-এ উপস্থিত হলেন। মোর্শেদ ক্বিবলা উনাকে দেখে বললেন, তোমার তো ইলমে মানতিক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বললেন, তোমার ভিতরে ইলমে তাছাওউফ প্রবেশ করাতে হলে ইলমে মানতি কমাতে হবে এবং এটা বলে তিনি ইলমে মানতিক কমানোর জন্য ফয়েয নিক্ষেপ করলেন। এতে হযরত ফখরুদ্দীন রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার ভিতরে কটকট শব্দ হতে লাগলো। তিনি মোর্শেদ ক্বিবলা উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হুযূর! আমার ভিতরে কিসের শব্দ হচ্ছে। মোর্শেদ ক্বিবলা বললেন, তোমার ভিতরে মানতিকের যে অতিরিক্ত ইলম সেটা কমিয়ে দিচ্ছি। তিনি বললেন, হুযূর! বেয়াদবি মাফ করবেন, ফখরুদ্দীনের ফখরই তো ইলমে মানতিক। তা না কমানোর জন্য তিনি আরজু পেশ করলেন এবং মোর্শেদ ক্বিবলার সবক নিয়ে নিজের এলাকায় চলে আসলেন। মোর্শেদ ক্বিবলার ইজাযত নিয়ে তিনি স্বীয় এলাকায় তা’লীম-তালক্বীন, দর্স-তাদরীসের কাজ করতে লাগলেন। তিনি জানেন শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সাধারণ মুসলমান তো বটে, যারা আলিম-উলামা, পীর-মাশায়িখ, ছুফী-দরবেশ দাবীদার তাদেরকেও শয়তান ওয়াসওয়াসা দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে এবং অনেককে বিভ্রান্ত করেও ফেলে। এমনকি ইন্তিকালের মুহূর্তেও শয়তান ধোঁকা দিয়ে ঈমানহারা করার চেষ্টা করে থাকে। সেজন্য মানতিকের ইমাম হযরত ফখরুদ্দীন রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-মুখতালিফ রিওয়ায়েত একশ থেকে- এক হাজার দলীল প্রস্তুত করে রাখলেন, যাতে ইন্তিকালের সময় উনাকে শয়তান ধোঁকা দিয়ে ঈমানহারা করতে না পারে। সত্যিই দেখা গেল, হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার যখন ইন্তিকালের সময় উপস্থিত হলো তখন ইবলীস হাযির হয়ে গেল। হাযির হয়ে সে মহান আল্লাহ পাক দুজন বলে যুক্তি পেশ করতে লাগলো। আর ইবলীসের সে বাতিল যুক্তি খ-ন করে হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ থেকে দলীল পেশ করতে লাগলেন। উনার সমস্ত দলীল শেষ হয়ে গেল তথাপি ইবলীসের বাতিল যুক্তি খণ্ডন করা গেলনা। এখন ঈমানহারা হয়ে ইন্তিকাল করার উপক্রম। তিনি এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে উনার মোর্শেদ ক্বিবলা তিনি যুহর নামাযের ওযূ করছিলেন। তিনি ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার এমন ভয়াবহ অবস্থা জানতে পেরে ওযূর পানি নিক্ষেপ করে বললেন, হে ফখরুদ্দীন রাযী! তুমি ইবলীসকে বল, বিনা দলীলে মহান আল্লাহ পাক তিনি একজন। বহু দূর থেকে যখন মোর্শেদ ক্বিবলার নিক্ষিপ্ত ওযূর পানি এসে উনার চেহারার উপর পড়লো এবং মোর্শেদ ক্বিবলা উনার ক্বওল মুবারকের আওয়াজ উনার কানে এসে পৌঁছাল তিনি ইবলীসকে জানিয়ে দিলেন, হে ইবলীস! তুমি জেনে রাখ, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি একজন। এটা আমি বিনা দলীলেই বিশ্বাস করি। তখন ইবলীস বললো, হে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী! আপনি আজকে আপনার মোর্শেদ ক্বিবলা উনার উসীলায় বেঁচে গেলেন। অন্যথায় আপনাকে ঈমানহারা করে মৃত্যুমুখে পতিত করে চলে যেতাম।

এ ওয়াক্বিয়া দ্বারা হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) উনাদের ফয়েয-তাওয়াজ্জুহ মুবারক উনার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

অতএব, হযরত নবী-রসূল (আলাইহিমুস সালাম) উনার উম্মত না হয়ে যেরূপ ইছলাহ ও নাজাত লাভ করা যায়না, তদ্রপ কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত না হওয়া পর্যন্ত ইছলাহ বা পরিশুদ্ধতা ও নাজাত লাভ করা যায়না। বরং শয়তানী প্রবঞ্চনায় পড়ে গোমরাহীতে নিপতিত হওয়াই স্বাভাবিক।

আর এ কারণেই জগদ্বিখ্যাত আলিম, আলিমকুল শিরোমণি, শ্রেষ্ঠতম মাযহাব, হানাফী মাযহাব উনার প্রতিষ্ঠাতা ও ইমাম, ইমামুল আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তিনি বলেন-

" لولا سنتان لـهلك ابو نعمان"

অর্থ : “(আমার জীবনে) যদি দু’টি বৎসর না পেতাম, তবে আবূ নু’মান (আবূ হানীফা) ধ্বংস হয়ে যেতাম।” (সাইফুল মুকাল্লিদীন, ফতওয়ায়ে ছিদ্দীক্বিয়া)

অর্থাৎ আমি হযরত আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহি আলাইহি) যদি আমার শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলা হযরত ইমাম বাকির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) অতঃপর হযরত ইমাম জা’ফর ছাদিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উনাদের নিকট বাইয়াত না হতাম, তবে আমি ধ্বংস বা বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম।

সুতরাং প্রমাণিত হলো, যে ব্যক্তি কোনো কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হবে না, তার পক্ষে শয়তানী প্রবঞ্চনা ও বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকা আদৌ সম্ভব নয়। কেননা কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হওয়া ব্যতীত ক্বলবি যিকির জারি করা অসম্ভব। আর ক্বলবি যিকির জারি করা ব্যতীত শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

" ومن يعش عن ذكر الرحـمن نقيض له شيطنا فهو له قرين. وانـهم ليصدونـهم عن السبيل ويـحسبون انـهم مهتدون"

অর্থ : “যে ব্যক্তি খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র যিকির থেকে বিরত (গাফিল) থাকে, আমি (খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক) তার জন্য একটি শয়তান নিযুক্ত করে দেই। অর্থাৎ তার গাফলতীর কারণেই তার সাথে একটা শয়তান নিযুক্ত হয়ে যায়। অতঃপর সেই শয়তান তার সঙ্গী হয় এবং তাকে সৎ পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে অর্থাৎ পাপ কাজে লিপ্ত করে দেয়। অথচ তারা মনে করে, তারা সৎ পথেই রয়েছে।” (পবিত্র সূরা যুখরূফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৬-৩৭)

তাই পরিশুদ্ধতা লাভ করার জন্য বা ক্বলবে যিকির জারি করার জন্য অবশ্যই একজন কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হতে হবে।

আর এ কারণেই পৃথিবীতে যত হযরত ইমাম-মুজতাহিদ ও আওলিয়ায়ে কিরাম (রহমতুল্লাহি আলাইহিম) উনারা আগমন করেছেন, উনাদের প্রত্যেকেই কোনো একজন শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হয়েছেন এবং উনারা উনাদের স্ব স্ব কিতাবে শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করাকে ফরয বলেছেন। যেমন- গাউছুল আ’যম, মাহবূবে সুবহানী, কুতুবে রব্বানী, ইমামুল আইম্মাহ হযরত বড়পীর আব্দুল ক্বাদির জিলানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তিনি উনার বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব সিররুল আসরার নামক কিতাবে লিখেন-

" ولذالك طلب اهل التلقين لـحياة القلوب فرض"

অর্থ : “ক্বালব জিন্দা করার জন্য অর্থাৎ অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য ‘আহলে তালক্বীন’ তালাশ করা অর্থাৎ কামিল মোর্শেদ ক্বিবলা উনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করা ফরয।” অনুরূপ ফতহুর রব্বানী কিতাবেও উল্লেখ আছে।

তদ্রূপ হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার বিশ্ব সমাদৃত কিতাব ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত কিতাবে, ক্বাইউমুয যামান হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার মাকতুবাত শরীফ কিতাবে, আওলাদে রসূল, আশিকে নবী হযরত আহমদ কবীর রেফায়ী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) উনার আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ কিতাবে উল্লেখ করেন যে ::

“অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য বা ইলমে তাছাওউফ অর্জন করার জন্য একজন কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হওয়া ফরয।” অনুরূপ তাফসীরে রূহুল বয়ান, তাফসীরে রূহুল মায়ানী ও তাফসীরে কবীর ইত্যাদি কিতাবেও উল্লেখ আছে।

মূলত: কামিল শায়েখ বা মোর্শেদ ক্বিবলা তিনি মুরীদের অন্তর পরিশুদ্ধ করতঃ খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ নৈকট্য মুবারক লাভ করানোর এক বিশেষ উসীলা বা মাধ্যম।

এ জন্যেই মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার কালাম পাক উনার মধ্যে নির্দেশ মুবারক করেন-

" يايها الذين امنوا اتقوا الله وابتغوا اليه الوسيلة"

অর্থ : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করো এবং খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য মুবারক লাভ করার জন্য ওসীলা তালাশ (গ্রহণ) করো।” (পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ -৩৫)

উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় “তাফসীরে রূহুল বয়ান” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে-

" الوصول لا يـحصل الا بالوسيلة وهى العلماء الـحقيقة ومشائخ الطريقة"

অর্থ : “ওসীলা ব্যতীত খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য মুবারক লাভ করা যায়না। আর উক্ত ওসীলা হচ্ছেন হাক্বীক্বী আলিম বা তরীক্বতপন্থী কামিল মোর্শেদ উনারা।”

উপরোক্ত দলীল-প্রমান ভিত্তিক আলোচনার আলোকে প্রতিয়মান হলো যে, প্রত্যেকের জন্য একজন কামিল শায়খ বা মোর্শেদ ক্বিবলার নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাছাওউফের শিক্ষা গ্রহণ করা ফরয।

স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সমূহ

গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ